ভারতকে পছন্দ করেন ৫৩.৬ শতাংশ, অপছন্দ করেন ৪১.৩ শতাংশ বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বাংলাদেশের ৪১.৩ শতাংশ মানুষ ভারতকে অপছন্দ করে আর দেশ হিসেবে ভারতকে পছন্দ করেন ৫৩.৬ শতাংশ বাংলাদেশি।
শনিবার (০৭ ডিসেম্বর) ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার এক জনমত জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপটির ফলাফল থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। দেশের মানুষ অন্যান্য উন্নয়নসহযোগী দেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন।
জরিপে ১,০০০ উত্তরদাতাকে কয়েকটি নির্দিষ্ট দেশকে ১ থেকে ৫ স্কেলে ‘ভোট’ দিয়ে তাদের মতামত জানান। স্কেলের ১ এবং ২ মিলে হয় ‘পছন্দ’ আর ৪ এবং ৫ মিলে ‘অপছন্দ।
উত্তরদাতাদের ৫৯ শতাংশ পাকিস্তানকে ‘পছন্দ’ স্কেলে বাছাই করেন। অন্যদিকে, ভারতের ‘পছন্দ’ স্কোর ছিল ৫৩.৬ শতাংশ। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটোর মধ্যে ‘অপছন্দ’ স্কেলে বেশ বড় ব্যবধান লক্ষ করা যায়।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, উত্তরদাতাদের ২৮.৫ শতাংশ পাকিস্তানকে ‘অপছন্দ’ করে মত দেন। অন্যদিকে, ভারতের ‘অপছন্দ’ স্কোর ছিল ৪১.৩ শতাংশ।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে ‘অপছন্দ’ হচ্ছে মিয়ানমার, যা আগে বার্মা নামে পরিচিত ছিল। উত্তরদাতারা মিয়ানমারকে ‘অপছন্দ’ স্কেলে ৫৯.১ শতাংশ এবং ‘পছন্দ’ স্কেলে ২৪.৫ শতাংশ রায় দেয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
অন্যান্য বাছাই করা দেশের মধ্যে, ‘পছন্দ’ স্কেলে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ভোট পায় (৬৮.৪ শতাংশ), এদিকে চীন (৬৬ শতাংশ), রাশিয়া (৬৪ শতাংশ) এবং যুক্তরাজ্য (৬২.৭ শতাংশ) বেশি দূরে ছিল না।
অক্টোবরের ১৩ থেকে ২৭ তারিখ, ভয়েস অব আমেরিকা দেশব্যাপী এই জরিপটি করে।
জরিপটি ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার এডিটোরিয়াল নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করে গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড। ভয়েস অব আমেরিকার ঠিক করে দেওয়া সুনির্দিষ্ট (ক্লোজ অ্যান্ড) প্রশ্নমালার ওপর ভিত্তি করে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড টেলিফোন ইন্টারভিউইংয়ের মাধ্যমে দেশের আটটি বিভাগে ১৮ বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সী এক হাজার মানুষের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের ১,০০০ উত্তরদাতা বাছাই করে নেওয়া হয়। সেখানে সমান সংখ্যার নারী এবং পুরুষ ছিলেন। তাদের মধ্যে ৯২.৭ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু বেশি ছিল ৩৪ বছর বয়সের নিচে এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে।
সীমান্ত হত্যার যে ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হল, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানি হত্যা।
সেদিন ভোরে কিশোরী ফেলানি তার বাবার সঙ্গে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে দেশে ফিরছিল। বিএসএফ-এর সৈন্যরা ফেলানিকে কাটাতাঁরের বেড়ার উপড়ে গুলি করে হত্যা করে এবং তার মরদেহ সারাদিন বেড়াতে ঝুলে ছিল ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রতি বছরই সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসেবে, ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত, মোট ১৬৪ জন নিহত হয়।
সীমান্ত হত্যাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্ক ভালো করার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় হিসেবে দেখেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন যে, ঘনিষ্ঠ, মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা দু’দেশের লক্ষ্য হলেও, কোনো কোনো বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
“মাঝে মাঝে কতগুলা প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মারা গেল, বাচ্চা ছেলে মারা গেলো, এগুলো মনে কষ্ট দেয়। আমরা মনে করি না যে ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে।
‘যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণগুলো যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে,’ ভিওএ’কে তিনি বলেন।
গঙ্গা থেকে তিস্তা
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অগ্রগতির অভাব বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করে যা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকলেও, শুধু মাত্র একটি –গঙ্গা– নিয়ে পানি বণ্টন চুক্তি আছে।
বাংলাদেশ ২০১০ সাল থেকে তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তি করার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে সেখানে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
গত জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা নিয়ে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বিরোধীদল বিএনপি তার তীব্র সমালোচনা করে।
‘আমাদের সমস্যা সমাধানে কোনো চুক্তি সই হয়নি। আমরা তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছি না, আর, এ বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি,’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩ জুন এক অনুষ্ঠানে বলেন।
অগাস্টে সরকার পরিবর্তনের পর দু’দেশের মধ্যে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভারত অভিযোগ করেছে যে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা পাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ সেই দাবি অতিরঞ্জিত খবর বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সম্প্রতি ইসকনের প্রাক্তন সদস্য এবং সম্মিলিত সনাতনী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ঘিরে দু’দেশের বাগ্বিতণ্ডা, পতাকা অবমাননার অভিযোগ, ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবনের নিরাপত্তা লঙ্ঘন ইত্যাদি ঘটনা ভিওএ’র জরিপের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরে ঘটে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি
অপরদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ করা গেছে।
প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সরকার একাধিকবার জানায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য পাকিস্তান ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক শীতল থাকবে। তবে ড. ইউনূসের সরকার সে রকম কোনো দাবি সামনে আনছে না।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ২ সেপ্টেম্বর জানান যে, তার দেশ ১২২ দেশের নাগরিকের জন্য ফি ছাড়া ভিসা দেবে, এবং সেই তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় গণমধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি আশা করেন দু’দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান ভ্রমণ শীঘ্রই চালু হবে, যা ২০১৮ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়।
গত ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মোট পাকিস্তান থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশে আসে, যেটাকে পর্যবেক্ষকরা ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেন।
৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেন
যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেন ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাংলাদেশি। যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানতে চাইলে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুব পছন্দ করেন এবং ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ মোটামুটি পছন্দ করেন বলে জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ অপছন্দ কোনোটাই করেন না বলে জানিয়েছেন ৫ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা, ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এ ব্যাপারে জানেন না বলেছেন, অপছন্দ করেন বলেছেন ৭ দশমিক ৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে খুব অপছন্দ করেন বলেছেন ১২ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা।
মন্তব্য করুন